মেসেঞ্জারে নক দিয়ে কেমন আছে জানতে চাইলে তিনি যে উত্তর দিলেন, তা আমার মনকে ব্যথিত করেছে। গণ-অভ্যুত্থানে পাওয়া আনন্দ গুমোট করে দিয়েছে।
আমার কুশল জানতে চাওয়ার উত্তরে তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকার বাড়িতেও গেটে ভাঙচুর করে গেছে গত পরশু। পুরো পাড়ায় ভাঙচুর করছে। গ্রামেও একই অবস্থা। প্রতিবার দল বদলেই এই দৃশ্য, এই ট্রমা আর নিতে পারি না।’
আরেক ফেসবুক বন্ধু বিভিন্ন সময়ে মেসেঞ্জারে নক দিয়ে আমার লেখালেখিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ধর্মীয়ভাবে তিনিও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। গত দুই দিন বিভিন্ন স্থানে হামলার খবর ও ছবির লিংক পাঠিয়েছেন একাধিক মানুষ। তার মধ্যে তিনিও একজন।
লিখেছেন, তাঁর এলাকায় হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক, আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘরের সম্পদ লুটপাট হচ্ছে। এমনকি উপজেলা শহর এলাকার কোনো দলীয় অবস্থান না থাকা অনেক লোকজনের দোকানও লুটপাটের শিকার হচ্ছে।
তার ফুফুর গোয়াল থেকে গরু নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে পথে নেমে স্বৈরাচারী শক্তির পতন ঘটিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ গণ-অভ্যুত্থান জয়ের নায়ক। সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে তাঁদের দেশ গঠনের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে।
আমরা গত কয়েক দিন শিক্ষার্থীদের ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে দেখেছি। সংসদ ভবন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নে নেমে পড়তে দেখেছি। সহিংসতা ও হামলা বন্ধেও তাঁদের নেতৃত্ব দিতে হবে।
আমরা অনেক মেধাবী-প্রতিবাদী তরুণকে এই গণ-আন্দোলনে হারিয়েছি। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে এমন এক বিজয় পেয়েছি, যার ভাগীদার আপনি-আমি সবাই। গণ-অভ্যুত্থান তো এমনই হয়।
এরপর আমরা আর বিভেদ চাই না। প্রতিহিংসা চাই না। চাই আইনের শাসন ও জনমানুষের নিরাপত্তা। কেউ অন্যায় করলে তার বিচার হতে হবে আইনের মাধ্যমে। সে জন্য সংবিধানসহ যে যে ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, তা করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
ফেসবুকে কাউকে কাউকে অনিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রকাশ করে বলতে দেখেছি, অরাজকতা গণ-অভ্যুত্থানের অংশ। তাঁদের বলব, দেশের মানুষ আইনের শাসন ও নিরাপত্তা চায়। ভয় ও গুমোট অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। আর একটা সহিংসতার ঘটনা, একটা মৃত্যুও কাম্য নয়।
সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বললে ফেসবুকে কাউকে কাউকে বাক-আক্রমণ করতেও দেখেছি। তাঁদের বলতে চাই, আমরা আর কথা বলতে গিয়ে ভয়ে থেমে যাওয়া বাংলাদেশ চাই না। কোনো লেখা লিখতে গিয়ে বারবার কি–বোর্ডের ব্যাক স্পেস চাপতে চাই না।
শেখ হাসিনার পতনের পর আমরা নির্ভয়ে তাঁর সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছি। একই সঙ্গে এখন যাঁরা অন্যায়-অবিচার করতে সচেষ্ট, তাঁদের বিরুদ্ধেও কথা বলতে পারার, প্রতিবাদ করার পরিবেশ নিশ্চিতের জন্যও এ গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে।
সফল এই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা এই মুহূর্তে মনেপ্রাণে এসব সহিংস কর্মকাণ্ডের অবসান চান। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মন্দির পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে দেখা গেছে তাঁদের।
অনেক মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। এই তরুণ প্রজন্মের আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কারা এসব সহিংসতা ঘটাচ্ছে ও লুটপাট করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এরই মধ্যে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থান তাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশা জুগিয়েছে। এবারও যেন তাদের আশাভঙ্গ না হয়।